অপত্যের প্রতি যত্নঃ
ডিমপাড়া বা সন্তান ধারণ করা থেকে শুরু করে এদের লালন পালন এবং রক্ষণাবেক্ষণ মাতা বা পিতা কিংবা উভয়ের সহজাত আচরণ। শিশুর জন্মলাভ ও তাদের স্বনির্ভর হওয়া পর্যন্ত পিতামাতা কর্তৃক পরিচর্যা নেয়াকে অপত্যের প্রতি যত্ন- নেয়া বা Parental care বলে। মাছ, উভচর, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণীতে এরূপ আচরণ লক্ষ করা যায়।
মাছের অপত্য যত্নঃ
প্রাণী আচরণ গবেষণায় তিন-কাঁটা স্টিকলব্যাক (Three-spined stickleback, Gastrosteus aculeatus) যাছের গুরুত্ব অনেক। এ মাছের বিস্তৃতি দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর (Black Sea), দক্ষিণ ইতালি, আইবেরিয়ান পেনিনস্যুলা, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়ায় জাপানের উত্তর অংশে, উত্তর আমেরিকা এবং গ্রীনল্যান্ডে। আচরণবিদ্যার অনেক গুরুত্বপূর্ণ MAT বিষয় এ মাছের আচরণের উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়েছে। প্রখ্যাত আচরণবিজ্ঞানী টিনবারগেন (Tinbergen) তিন- কাঁটা স্টিকলব্যাকের উপর গবেষণা করেছেন। তাঁর গবেষণার ভিত্তিতে এ মাছের অপত্যের প্রতি যত্নের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো।এক থেকে তিন বছর বয়সে তিন কাঁটা স্টিলব্যাক পরিণত ( mature) হয়। জননকাল ছাড়া অন্য সময়ে ঝাঁকবদ্ধ হয়ে বাস করে। বসন্তকালে অর্থাৎ জননকালে পরিণত স্টিকলব্যাকেরা দলহীন হয়ে উপকূলবর্তী অগভীর পানির জলাশয়ে নিজস্ব বিচরণ পরিসীমা নির্ধারণ করে সতর্ক পাহাড়ায় নিযুক্ত থাকে। কারও অনুপ্রবেশে হানাহানি না করে বিভিন্ন শারীরিক কসরত ও বর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়। বিচরণ পরিসীমা প্রতিষ্ঠার পর সেখানে বাসা নির্মাণ শুরু করে। বাসা নির্মাণে শুধু পুরুষ সদস্যই কাজ করে। বাসা নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জায়গার তলদেশ থেকে মুখভর্তি বালু তুলে প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার দূরে নিক্ষেপ করে। এভাবে একটি অগভীর গর্তের সৃষ্টি হলে পুরুষ মাছ সূত্রাকার শৈবাল ও অন্য জলজ উদ্ভিদ, নুড়ি ও অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ জড়ো করে বৃক্ক থেকে ক্ষরিত এক ধরনের প্রোটিনজাত আঠালো পদার্থে আটকে দেয়। সকল ভিন-কাঁটা স্টিকলব্যাকের বাসার নির্মাণশৈলী এক হয় না, স্বতন্ত্র রুচির বিষয় মাছের বেলায় ও প্রযোজ্য । কোন কাঠামো কোন স্ত্রী মাছের পছন্দ হবে তারও ব্যাপার আছে। যা হোক, বাসাটি দুমুখ খোলা, মধ্যভাগ ফাঁকা ও সামান্য চওড়া ধরনের।
বাসা নির্মাণ শেষ হলে পুরুষ মাছ উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় স্ত্রীমাছকে আকৃষ্ট করে বাসায় ঢুকিয়ে লেজটাকে ধাক্কা দিয়ে ডিম পাড়তে উদ্বুদ্ধ করে। ডিম পাড়া শেষ হলে পুরুষ মাছ অতিদ্রুত বাসায় প্রবেশ করে ডিমগুলোকে নিষিক্ত করে। একটি বাসায় দু-তিনটি স্ত্রীমাছ ডিম পাড়তে পারে। এরপর পুরুষ মাছটি পিতা ও মাতা উভয়ের ভূমিকা পালন করে ডিমের দেখা শোনা আরম্ভ করে।
নীড় ও নীড়ের ভেতর থাকা নিষিক্ত ডিমগুলো থেকে সুস্থ পোনা উৎপাদন, রক্ষা, যত্ন নেওয়া ও সবশেষে নিরাপদে পরিবেশে ফিরে যাওয়া অনুকূলে রাখতে পুরুষ মাছ সদাব্যস্ত থাকে। এ সময় বাসার কাছে নিজ প্রজাতির সদস্যসহ কোনো মাছ বা ক্ষতিকর প্রাণীর প্রবেশ রোধ করতে মাছ সদা তৎপর থাকে। ডিম ফোটার অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য স্টিকলব্যাক 'এক অদ্ভূত আচরণ করে (বাসায় প্রবেশ পথের সামনে মাথা নিচু করে তীর্যকভাবে অবস্থান নিয়ে বক্ষপাখনা সামনের দিকে সঞ্চালিত করে। এভাবে অক্সিজেন চাহিদা নিশ্চিত করতে পানিস্রোত অব্যাহত রাখে। এ প্রক্রিয়ার নাম ফ্যানিং (fanning)।
সাত-আটদিনের মধ্যে ডিম ফুটে পোনা বেরিয়ে বাসা ত্যাগ করতে শুরু করলে ফ্যানিং বন্ধ করে দেয়। পোনাগুলো পাহারা দেওয়ার সময় স্টিকলব্যাক আক্রমণাত্তক হয়ে উঠে। পোনার দল অটুট রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোনো কারণে দলের কিছু পোনা দলছুট হলে পুরুষ মাছটি দ্রুত সেগুলোকে মুখে তুলে এনে মূলদলে ছেড়ে দেয়। দুসপ্তাহ পর পোনা দলবদ্ধ চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে অতিযত্ন ও সতর্কতার মধ্যে রেখে বড় করে তোলা ভবিষ্যৎ বংশধরগুলোকে ছেড়ে নিজের পূর্ণবয়স্ক ঝাঁকে ফিরে যায়।